ফারুক আহমেদ, ত্রিশাল :
ময়মনসিংহের ত্রিশালে শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী এক সংগ্রামী নারী সালমা আক্তার সম্পা
সালমা আক্তার সম্পা ১৯৭৩ ইং সালের ১ জানুয়ারি সম্ভ্রান্ত কট্টর পন্থি মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করে। যে পরিবারে মেয়েদের প্রাথমিক শিক্ষার পরই বিয়ের পিড়িতে বসতে হত। তখনকার দিনে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা মোটেই ভাল ছিল না। তার বাবা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। দেশে আশার পর কোন কর্ম করার মত সামর্থ ছিল না। সম্পা তার বাবার বড় সন্তান। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। এক সময় তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। সে টিউশনি করে , চটে নকশীর কাজ করে , পাখা বানানো, সেলাইয়ের কাজ করেছেন। এগুলো থেকে উপার্জিত সামান্য টাকা জমা হলেই লাল চিনি, মরিচ, হলুদ কম দামে ক্রয় করে ঘরে রেখে দিতেন। দাম বাড়লে বিক্রি করে দিতেন। তাতে সামান্য পরিমান লাভ হত তার। সংসারের খরচের যোগান দিতে হত। আমার পড়াশোনার খরচ চালাতে হত। নতুন বই কিনার সামর্থ ছিল না। অর্ধেক দামে বই কিনে পড়তে হত তার । নিজের অর্জিত আয় দিয়ে এস.এস.সির ফরম ফিলাপ করে সে। ত্রিশাল নজরুল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় হতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে উত্তির্ণ হন ১৯৮৭ সালে। এক পর্যায়ে অভিভাবক তার লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে শুরু করে। তাদের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে অসম বয়স্ক পাত্রের সাথে বিয়ে দিতেও চেষ্টা চলে। অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তার মনোবল দৃঢ় ছিল। পড়ার নেশা তার মনে চেপে বসে। সে তার এক মামার সহযোগীতায় স্থানীয় নজরুল কলেজে ভর্ত্তি হয়। সে নিজের খরচ নিজেই চালাই। তখন ত্রিশালে বিদ্যুৎ আসে নাই। কেরোসিন তৈল কুপি বাতিতে ভরে লেখাপড়া করতে হত তাকে। মাঝে মাঝে তৈল থাকতো না। অনেক সময় চন্দ্রের আলোতে পড়তে হত। নতুবা দিনের বেলায় পড়া শেষ করতে হত। তার ছোট আর ৪ ভাই ও ৩ বোন ছিল। ওদেরকেও কোলে রাখতে হত।অনেক কষ্ট করে এইচ.এস.সি-র ফরম ফিলাপের টাকা যোগার করে পরীক্ষা দেয় সে। টাকার অভাবে কোনদিন প্রাইভেট পড়তে পারে নাই।এমন পরিবারের মেয়ে, কাহার নিকট হাত পাততেও পারিনা।আল্লাহর রহমতে এইচ.এস.সি-তে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তির্ণ হন ১৯৮৯ সালে। এইচ.এস.সি পাশ করার পর আমার বাসার সামনে ১৯৯১ সালে গ্রামীণ বীমার অফিস শুরু হয়। অফিস সহকারী হিসাবে গ্রামীণ বীমা ডিভিশন, ডেল্্টা লাইফ ইনসিওরেন্স কোং লিঃ -এ চাকরি হয় তার। মাসিক বেতন ৭৫০/- টাকা। কিছুদিন পর তার বিয়ে হয়ে যায়। কিছুটা আর্থিক আলোর মুখ দেখে সে। তার স্বামী খুব সামাজিক মানুষ। শিক্ষানুরাগী। স্বামীর সহযোগীতায় নজরুল কলেজ হতে বিএ পাশ করে সে। এরই মধ্যে তার প্রথম ছেলে শশী জন্ম গ্রহন করে।”শিশু শশী” ১৪ মাস বয়সে ডায়রিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে ১৯৯৪ সালের ২৭শে নভেম্বর জীবন দিয়েছে। রেখে গিয়েছে প্রিয় স্মৃতি ও প্রেরণা যার সংগঠিত রূপ নেয় তার নিজ হাতে গড়া “শশী ফাউন্ডেশন”। একজন ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় তার প্রথম সন্তান মারা যায়।
সন্তান মারা যাবার পর সে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। আত্মহত্যার চেষ্টা করে সে। স্বামীর সহযোগীতায় ধীরে ধীরে সুস্থ্য হয় সে। বেশ কিছু বছর পর স্থানীয় নজরুল কলেজ থেকে মানবিক বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বিএ পাশ করে সে ১৯৯৬ সালে। পরবর্তী পর্যায়ে আনন্দমোহন কলেজ থেকে প্রাইভেটে এম.এ পাশ করে ২০০০সালে। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন আইটি কোর্স করি। সততা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করার ফল হিসাবে প্রমোশন পেয়ে ডেল্্টা লাইফ ইনসিরেন্স কোং লিঃ -এর হিসাব বিভাগের -এর দায়িত্ব পায় সে। তার ইচ্ছা ছিল অবহেলিত নারী সমাজকে নিয়েকাজ করার। তার আর্থিক সাহায্যেছোট দুই বোন ও চারভাই মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে। তার স্বামীর দেয়া একজোড়া কানের ফুল ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করে, তার ছেলের “শশী”-র নামে ১৯৯৯ সালের নভেম্বরেশশী ফাউন্ডেশন নামীয় সামাজিক সংগঠন রেজিষ্ট্রেশন প্রাপ্ত হয়। যার রেজিঃ নং ম০১০৭৮, তারিখ-২৭/০৯/১৯৯৯খ্রিঃ। শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান(অবৈতনিক) হিসাবে দায়িত্ব পালন করে সে। শশী পাঠাগার দিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়।
২০১২ ইং সালে শশী একাডেমী নামে পূর্নাঙ্গ বিদ্যালয় চালু হয়। ২টি বিভাগ খোলা হয়। সাধারণশাখা ও কম্পিউটার বিভাগ। সালমা আক্তার চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করে।
২০০৩ইং সালে ব্র্যাকের সহযোগী সংগঠন হিসাবে উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম চালু হয়। ৩৪টি উপ-আনুষ্ঠানিক স্কুল চলমান।
বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে শশী শিশু নিকেতন নামে ৩০টি স্কুল চালু আছে।উক্ত প্রতিষ্ঠানে ৩৪ জন নারী শিক্ষক ৪ জন নারী সুপারভাইজার কর্মরত আছেন। উক্ত স্কুলে ৮০% শিক্ষার্থী কন্যা। সালমা আক্তার -কে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। তার দ্বারা যাহাতে অনেক নারী শিক্ষিত হয় এবং কর্ম করে খেতে পারে, তারই সামান্য চেষ্টা। ২০০৬ সালে ইউনিসেফ -এর একটি প্রকল্পে যুব সমাজের মধ্যে এইচআইভি (এইডস) প্রতিরোধে ১৪-২৪ বছরের কিশোর কিশোরীদের নিয়ে ৬ বছরের একটি প্রকল্পে কাজ শুরকরোনা কালীন সময়ে ময়মনসিংহ রেলষ্টেশনে ছিন্নমুল মানুষের মাঝে তার ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে তার ২ মেয়ের সহযোগীতায় শীত বস্ত্র বিতরণ করা হয়। তার প্রয়াতসন্তান শশীর স্মরণে ছিন্নমূল মানুষ ও শিশুদের মাঝে সপ্তাহে তিনদিন রান্না করা খাবার দেয় সে।
২০০৭ সালে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের সংযোগী সংগঠন হিসাবে বিনামূল্যে১৭ লক্ষ টাকার হাঁস, মুরগী, ছাগল বিনামূল্যে বিধবা ওদুস্থমহিলাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
নারী শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুস্থ অসহায় শিক্ষার্থীর লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ২০১০ সাল শিক্ষাবৃত্তি চালু হয়। বর্তমানে প্রকল্পটি চলমান।
প্রতি বছর পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে গাছের চারা বিতরণ করা হয়। শশী একাডেমীর মাঠে বৃক্ষরোপন করেন সাবেক সচিব বিএনএফ -এর চেয়ারম্যান এ এফ এম ইয়াহিয়া চৌধুরী।
২০০৩ইং সালে শুধু মাত্র নারীদের নিয়ে কাজ করা জন্য শশী মহিলা উন্নয়ন সংস্থার সরকারী রেজিষ্ট্রেশন পায়। রেজিঃ নং -মবিঅ-১১৩/০৩ তাং ২২/১০/২০০৩ খ্রিঃ। মহিলাদের বিভিন্ন প্রকল্প চালু করা হয়। এখানে শুধু মহিলারই কাজ করেন। ২০১২ ইংসালে সফল নারীদের নিয়ে জয়িতা নারী উন্নয়ন সংস্থার সরকারী রেজিষ্ট্রেশন পায়। রেজিঃ নং-মবিঅ/ময়মন/২০১৬-৩১৬ তাং ০৭/০২/২০১৬। তার চাকুরির কর্মস্থলে সততার সাথে পালন করে যাচ্ছে সে। তার সততা, পরিশ্রম ন্যায় নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করায় নিয়মিত প্রমোশন পেয়ে বাংলাদেশের বৃহৎ বীমা শিল্প ডেল্্টা লাইফ ইনসিওরেন্স কোম্পানী লিঃ এর ময়মনসিংহ জোনাল কার্যালয়ের হিসাব বিভাগের দায়িত্ব পালন করছে সে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমি ত্রিশালের মঠবাড়ী ইউনিয়নে মেসার্স সালমা আক্তার সম্পা ফিসারিজ গড়ে তুলে সে। পরিবারের আমিষের চাহিদাফিসারিজ থেকে মেটানো হয়। পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে বাকী মাছ বিক্রি করে সে। নিয়মিত আয়কর পরিশোধ করে সে। বহু সংগ্রামের পর বর্তমানে সে স্বামী ও তিন মেয়ে নিয়ে সুখে আছেন সালমা আক্তার সম্পা।